মাটির মানুষ

– মাগি, কার লগে পিরিতির কথা কস?

যাকে কথাটা বলে হাজেরা বেওয়া, সে এসব আলতু-ফালতু কথার উত্তর দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না। নিত্য তিরিশ দিনের যত ঘ্যানর-ঘ্যানর – তা ওই চুলোর নিচে কবরের মধ্যে জাউল্ল হরদার মানে জালাল সরদারের সাথে। বাকি সব খোদেজার সাথে। হরদার মারা যাবার পর হাজেরা বেওয়ার কথা মাত্র জীবিত ও মৃত দুই জনের সাথে।

অভিশপ্ত জাউল্লা পাড়ার হরদার বাড়ি মাছের রাণী খোদেজার যখন বিয়ে হয়, তখন তার বয়স ষোল। হাজেরার একমাত্র পোলা আলামিনকে নিয়ে ভাঙা ঘরের মাটির বিছানায় ঘুমায় যখন হাজেরা-আলামিন, তখন তাদের নিচে কবরের মধ্যে ঘুমায় আলামিনের দাদা-দাদি। হলতা নদীর পার্শ্ববর্তী এ পাড়ায় হাজার দুই জাউল্লা মানুষের বসবাস মৃতের সাথে। ঘরের মধ্যে কবর। বাইরে কবর। ডোয়ার পাশে, চুলার নিচে, এমনকি পায়খানার নিচেও আছে চৌদ্দ পুরুষের কবর।

কাঁঠালিয়া উপজেলার হলতায় মাছ ধরে যে আলামিন, তার গায়ের রং মা কালীর মতো। খোজেদা পাড়ার মাইয়া হলেও – তার বয়স যখন পনেরো, তখন পার্শ্ববর্তী বিষখালি নদীতে গোপনে মাছ ধরা শেখায় আলামিন। কোন জায়গায় কারেন্ট জাল ফেলতে হবে, জোয়ারে না ভাটায়, অমাবশ্যা না পূর্ণিমার জোবায়; খোদেজা-আলামিনের রং-ঢং-ভং বাড়ে মাছে-পানিতে-জালে। খোদেজার জালে মাছ পড়ে প্রচুর। চিংড়ি, বায়লা, ভাটা, ঝাটকা, কাঁকড়া, রুইমাছ। আলামিনের কপালে মাছ নেই, আছে শুধু শামুক। নিয়ে আসে বাসায় হাঁসের জন্য। রাগে-হিংসায় আলামিনের গা পুড়ে যায়। পূর্ণিমার ভাঁটিতে যখন খোদেজা মাছ মেরে ছোট্ট ডিঙি নৌকা ভরে ফেললো; তখন আলামিন চাঁদ দেখে। চাঁদের আলো ও নয়া মাসিক-রোগ আক্রান্ত খোদেজাকে দেখে দুচোখ ভরে! যক্ষ্মা রোগীর কাশির মতো, ফস্‌্‌ করে বুকের পাঁজর ভেঙে বের হয়ে যায়;

– ওই ছেমরী, তুই তো মাছের রাণী হয়ে গেলি রে!

– মাছের রাজা হইবা না সারা জীবন শামুক মারবা?

এই টিপ্পনি থেকেই ষোল বছর বয়সেই খোজেদাকে কবুল করে, অকথ্য কষ্টে যোগাড় করা স্বর্ণের একটি নাক-ফুল দিয়ে।

হাজেরা বেওয়ার স্বামীকে চুলার নিচে কবর দেয়ার পর আলামিনই ছিল তার স্বামী-সংসার। কিন্তু ষোল বছরের মাছের রাণি খোদেজার আগমনে তার সংসার চলে যায় বারান্দার মাটিতে। একটা পাটিতে ঘুমায় না জেগে থাকে, বোঝা যায় না। সারাদিন কারো সাথে কথা বলে না। বলতে গেলে চুলার সাথে ক্যাচম্যাচ করে। ক্যাচাল লাগায় খোদেজার লগে। তার স্বামী মারা গেছে – এখন পোলাডাও গেল। শামুক বেইচা আলামিন কয় টাকা পায়? জাউল্লাগো চাউল লাগে বেশি। বেওয়া ক্রমশ বুড়ি হতে থাকে। বুড়ি হতে-হতে হয়ে যায় পথের পাঁচালীর ইন্দিরা ঠাকরুণের মতো। লাঠি ছাড়া, গালি ছাড়া কথা কয় না। যত কথা সব চুলার লগে;

– বোজঝো, লায়েক পোলা তো আমাগো অহন চেনে না।
– হর্দ্দারগো, আফনে কত মাছ মারতেন আর এহন লায়েক মারে শামুক। ভাতের খবর নাই। আমি কি শামুক খামু? আফনে খাইবেন?
– বোজঝেন, লায়েক তো কাম-কাউজ বাদ দিয়া মাছের রাণির লগে পীড়িত মারে।
– হোনছেন, কিসতি ভাইয়ের কাছ থেইক্কা কর্জ লইছে। বৌরে না-কি নূপুর বানাইয়া দিবো। আফনে দেছেন আমারে আলতা। ক্যা দ্যাশে আলতা নাই? মাগিডা আমার পোলার মাথাডা খাইছে।

– কথা জিগাইলে উত্তর দ্যান না ক্যা? ভোট চাইতে আইছেলে জালাল হর্দ্দার। কয় জাউল্লাগো জীবন তো নৌকা। মারকা তো একটাই। ছিল মারতে কইছে চক্ষু বন্ধ কইরা। মারুম?

– আফনেগো আমলে তো গোরস্হান ছিল না। মারকা জিতলে বোলে আমাগো দাফনের জইন্যে আলাদা খাস জমি দেবো। যদি দেয়, তয় কিন্তু আফনারে আমি মাডিসহ লইয়া যামু। পুইত্তা আমু নতুন মাডিতে!

– আমি আফনের শইলের উপর রান্ধি, আফনের গরম লাগে না? আচ্ছা রাইতে গোবর পানি দিয়া ল্যেইপা দিমু আনে। খুশি হইছেন, তয় হাসেন।

হরদার হাসেন না। তবে হাসে ঘর, মানে ছাপড়ার লগে দাঁড়িয়ে-থাকা একটা বেহুদা তুত গাছে ঝুলে থাকা বাদুড়ে।

খোদেজার বয়স দেখতে-দেখতে লাউয়ের মতো পুষ্ট হতে-হতে আঠারো হয়ে যায়। একদিন জং-ধরা টিনের ফুডাফাডা দিয়া চাঁন্দের আলোয় যখন মাছের রাণি কাছিমের মতো ফরসা গলা বের করে, আর আলামিন যখন উপযুক্ত সময়ে শামুকের শক্ত আবরণ থেকে মুখ খোলে, তখনও বারান্দায় নেড়ি-কুত্তার মতো কুণ্ডলি পাঁকিয়ে শুয়ে থাকে বেওয়া বুড়ি। কান পেতে শোনে মাছের রাণির ফিসফিসানী।

– ইলিশ মাছের পেট ভাতি ডিম থাকে। আমার অতগুলা লাগবে না। একখান ডিম দিতে পারবা না? বড় হইলে হলতায় মাছ না পাইলে বিষখালি নদীতে যাইবো। আমারও তো নাতি-পুতির মুখ দেখবার মন চায়। আব্বা-আম্মা কইয়া গলা ফাঁডাইবে; মন চায়। তোমার চায় না?

ঠিক সেই রাত থেকেই আলামিনের জ্বর শুরু। জ্বর নিয়েই গাঙ্গে যায়। খালি হাতে ফেরে। রাইতে আবারো জ্বর।

কালো-মানুষটারে খাইলো শেষ পর্যন্ত কালা-জ্বরে। ইন্না লিল্লাহ্‌্‌ ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। হরদার পাড়ায় ভোটের সময় ছাড়া বাইরে থেকে কোনো লোকজন আসে না। বাইরের মসজিদের ইমাম সাইবেরে কইলে পাতলা কাডে। ফলে, নিজ উদ্যোগে সুদখোর জালাল সরদারই নামাজের জানাজা পড়ায় গাঙের পাড়ে। আসল সমস্যা শুরু হয় এরপরে। গোড় হবে কোথায়? অসুস্হ বেওয়া বুড়ি কয় ডোয়ার পাশে দিতে। কিন্তু অজ্ঞান হয়ে যাওয়া মাছের রাণি কয়; ঘরের মধ্যে হে থাকবে – আমি থাকমু তার লগে। হরদার পাড়ায় জাউল্লাদের কাছে এইডা কোনো খবর না। এইডাই নিয়ম। সবাই খুব যত্ন করে ঘরের মধ্যে খোনতা দিয়ে ছয় ফুট বাই দেড় ফুট সাইজের কবর খুঁড়ে শরিয়ত মোতাবেক দাফন করার পর পরই চলে আসে মনকির নকির!

শামুক রাজা কবরে। বেওয়া বুড়ি বোবা হয়ে বারান্দায় বসে থাকে সারাদিন। রাতভর সুরে-সুরে আলামিনের জন্য কান্দে। মাছের রাণি স্বামীর কবরের উপরে, স্বামীর লুঙ্গি-গামছা বিছিয়ে শুয়ে থাকে মৃত মানুষের মতো। পেট জ্বলে, মন জ্বলে, চুলা জ্বলে না। জালাল সরদার কয় দিন খাওয়াবে? নৌকা বানানোর জন্য সুদের টাকা এখনও পাওনা আছে বেওয়ার কাছে। এখন দুই বেওয়ার দায়িত্ব আসলে নয়, নকলে-নকলে অল্প-অল্প সুদটুকু পরিশোধ করার জন্য আড়-চোখের চাপাচাপি। নাক-ফুল কেনার জন্য যে কিস্তি-ভাই টাকা দিয়েছিল, সে যতটা না কিস্তির জন্য চাপ দেয়, তার চেয়ে বেশি চেয়ে থাকে মাছের রাণির দিকে। দিকেও নয় – সরাসরি বুকের দিকে। আর পারে না সহ্য করতে খোদেজা। একদিন বলেই ফেললো চিৎকার করে;

– ওই বুড়ি, না খাইয়া মরুম না-কি মাছ মারতে যামু? ঘরে আমার সোয়ামী, চুলার তলে তোমার। হ্যাগো তো খিদা লাগে না। তুমি রানবা আর আমি মাছ মারি, রাইতে যার-যার সোয়ামী লইয়া বাঁচি। না-কি কও?

– যা-যা বিষখালিতে গিয়া বিষ খাইয়া মর।

মানে বেওয়ার অনুমতি আছে ধরে নিয়েই খোদেজা জাল-নৌকা নিয়ে বের হয়ে পড়ে। সরাসরি হলতায়। মাছের রাণি জানে কোথায় মাছ আছে। সে আস্তে জাল নৌকায় বসে টানে বিষখালি পর্যন্ত। ব্যস্‌্‌ কেল্লা ফতে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয় নি খোদেজাকে। মাছ বিক্রি করে চাল-ডাল আর কিছু মাছ ঘরের জন্য নিয়ে বাড়ি আসে সে। হাজেরা টাটকা বইলা মাছ পাইয়া খুশিতে চোখ চকচক করে। সে বিপুল উৎসাহে রান্দে-বান্দে। নিজে খায় স্বামীর জন্য চুলার মুখে খাবার রেখে দেয়। যদি খিদা লাগে, রাইতে হয়ত খাইতে পারে। মাছের রাণিও পেট ভরে ভাত খাওয়ার আগে আলামিনের কবরের সামনে এসে বলে, ন্যাও, ভাত গেলো। বাইলা মাছ। হাঁ করো, আমি খাওয়াইয়া দেই। পানি দিমু?

– ওই মাগি কার লগে কথা কস? – তোমার পোলার লগে। ভাত খাওয়াই।
– মরস না ক্যান দামড়ী?
– বুড়ি এক পাও তো চুলার মইধ্যে। অন্য পাও দিয়া লাফালাফি বন করো। আলামিনের ভাত খাওয়া শ্যাষ। এখন ঘুমামু কথা কম।

এ কথায় বুড়ি অফ যায়। মনে-মনে ভাবে, ছেমড়ির মাথাডা এ্যাহেবারে খারাপ হইয়া গ্যাছে। হরদার বাড়ির অভিশাপ লাগছে। অনেক দিন পর দুই বেওয়া মরার ঘুম দেয় মৃত স্বামীদের জড়িয়ে ধরে –

বিষখালি নদীর পাশের গ্রাম মালো পাড়া। এ পাড়ার বিশ বছরের সমর মালো মাছ ধরতে-ধরতে চিকন একটা চিপা খালের মধ্য দিয়া কখন যে হলদা নদীতে এসে পড়েছে সেটা সে টের পাওয়ার আগেই টের পায় মাছের রাণি। প্রায় ঝগড়ার মতো চিৎকার করে উঠে;

– ও দাদা, আফনাগো দ্যাশে যান। আফনে আমাগো মাছ মাইরা নিয়া যাইবেন, তয় আমরা খামু কী?

প্রশ্ন-উত্তর, উত্তর-প্রশ্ন, প্রশ্ন-প্রশ্ন, উত্তর-উত্তর যে খেলা – সে খেলায় মেতে উঠে আঠারো ও বিশ বছরের খোদেজা ও সমর। সারাদিন মাছ – মাছের গল্পের চেয়ে, দুজন দুজনের দিকে চেয়ে থাকাটাই একসময় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। অনিবার্য পরিণতির দিকে যেতে থাকে সমর বনাম যবনের জাল। সমরই প্রস্তাব করে, আলাদা-আলাদাভাবে মাছ না মাইরা, লও যাই একসাথে মারি। মাছও বেশি পামু, ভাগেও বেশি পামু

– ক্যামনে?

– তোমার জাল আর আমার জাল আসো জোড়া দিয়া বড় কইরা বানাই। তারপর হলতা দিয়া শুরু কইরা বিষখালি। আবার ফেরত। দেখবা, কয়দিনের মধ্যেই আমরা রাজা-রাণি হইয়া যামু।

খোদেজা মাছের লোভে, টাকার লোভে, সাদা রংয়ের সমরের পেশি-বাহুর আকর্ষণে জালে জড়িয়ে পড়ে। দুইজনের জাল জড়িয়ে পড়ে জলে। মাছও পড়ে মৌমাছির মতো ঝাঁকে-ঝাঁকে। কয়েক মাসের মধ্যেই জালাল সরদারের ঋণ পরিশোধের প্রস্তাব খোদেজা দিলে, জালালের বউ সেলিনা ফোড়ন কাডে;

– মালো গো মাছের পয়সা সরদার খায় না। গাঙ্গের মধ্যে বাংলা সিনেমা আর কত যে দ্যাখতে হইবো?

কথাটা কানে যায় হাজেরা বেওয়ারও। রাইতে যখন মাছের রাণি আলামিনকে ভাত খাওয়ায় তখনই টিপ্পনি কাটে বুড়ি।

– হয়, ভাত খায় আলামিন। মাছ খায়। আরে হরদারের পোলা, মালোগো মাছ আমরা কোনো দিন খাইছি? তোর বউর মনে দুর্গাপূজার রং লাগছে, বুঝলি মরার পোলা মরা।

সেই রাতেই মাছের রাণি কান্দে। কান্দে না আর্তনাদ করে। খাওয়াদাওয়ার পরে এক ফুঁ দিয়ে টেমি-বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে আলামিনের শরীরের উপর। ফিসফিস করে বলে, একবার একটা ডিম চাইছিলাম। দেও নাই। আমারও তো মা হইতে মন চায়, চায় না?

খোদেজা মাটির উপর আরো শক্ত করে শুয়ে পড়ে। জড়িয়ে ধরে মাটিকে। হাতের নখ দিয়ে খামচে ধরে মাটিকে। কবরের সাথে নিজেকে বিলিয়ে দেয় শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে। সারা রাতের ঘামার্ত শরীরে মাটির মাখামাখি দেখে মাছের রাণি ভোর রাতে ঘুমিয়ে পড়ে – ভাদ্র মাসের ইলিশের মতো। বারান্দায় বসে বেড়ার ফুটো দিয়ে ছেলের বউয়ের আলুথালু শাড়ির অবস্হা দেখেই বুড়ি বেওয়া ফোকলা দাঁতে হাসে খিল খিল করে।

সেই ভাদ্রের রাতেই মাছের রাণি-র তলপেট ভর্তি করে ডিম আসে!

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন
32 Shares